সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জন্য অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ কেন্দ্রীয় অর্থ ও কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারমনের
২০১৪-২৩-এ প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির পরিমাণ ছিল ৫৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.৩৫ শতাংশ
তরুণদের জন্য ৫০ বছর মেয়াদের সুদমুক্ত ঋণ
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে বিশেষ নজর দেবে সরকার
দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গড়বে সরকার
বর্তমানের কর কাঠামো অপরিবর্তিত
সংক্ষিপ্ত বাজেট – প্রথম পর্ব
কেন্দ্রীয় অর্থ ও কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারমন আজ সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জন্য অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করেছেন। বাজেটে মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে ১১,১১,১১১ কোটি টাকা, যা জিডিপি-র ৩.৪ শতাংশ।
বাজেট পেশ করে শ্রীমতী সীতারমন বলেন, বিগত ৪ বছরের বাজেটের ফলে আর্থিক অগ্রগতি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭.৩ শতাংশ, যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিশ্বজুড়ে আর্থিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারতীয় অর্থনীতির ভিত মজবুত রয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (আইএমএফ)-এর ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক, অক্টোবর ২০২৩-এর রিপোর্টে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের জুলাই-এ ভারতের অগ্রগতির হার ৬.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬.৩ শতাংশে পৌঁছনোর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। এই তথ্যই ভারতের আর্থিক শক্তির ওপর বিশ্বের ক্রমবর্ধমান আস্থার বার্তা দিচ্ছে, যেখানে গোটা বিশ্বে অগ্রগতির হার ছিল ৩ শতাংশ।
আইএমএফ জানিয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হতে পারে। এছাড়া, বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফ, ওইসিডি এবং এডিবি-র মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতের অগ্রগতির হার যথাক্রমে ৬.৪ শতাংশ, ৬.৩ শতাংশ, ৬.১ শতাংশ এবং ৬.৭ শতাংশে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে।
রাজস্ব সংগ্রহ ও জিএসটি সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য ভারতের অর্থনীতি মজবুত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০২৩-এর ডিসেম্বরে জিএসটি সংগ্রহ হয়েছে ১.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা। এ নিয়ে সাতবার জিএসটি সংগ্রহ ১.৬ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে বলে জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী মূলধনী ব্যয়ের জন্য রাজ্যগুলিকে দেওয়া ৫০ বছরের সুদমুক্ত ঋণের মেয়াদ এ বছর পর্যন্ত বহাল রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। চলতি বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। শ্রীমতী সীতারমন জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপি-র ৫.১ শতাংশ।
ভারতীয় অর্থনীতির কিছু উজ্জ্বল সাফল্যের কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী জানান, মোট মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪.৯০ লক্ষ কোটি টাকা। রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০.০৩ লক্ষ কোটি টাকা, যা ভারতের অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী জানান, ২০১৪-২৩ বর্ষে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০০৫-১৪ বর্ষের তুলনায় দ্বিগুণ। বিদেশি লগ্নির পথ সুগম করতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক লগ্নি চুক্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানান শ্রীমতী সীতারমন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এবং চারটি গুরুত্বপূর্ণ জাতির ওপর নজর দিয়ে থাকেন। এগুলি হল – গরিব, মহিলা, যুব এবং কৃষক। তিনি বলেন, এঁদের চাহিদা, আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ এবং কল্যাণকেই সরকার সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিচ্ছে কারণ, এঁরা এগোলেই দেশ এগোবে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, উন্নয়নের প্রতি সরকারের মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গী একেবারে তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। গত ১০ বছরে উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে প্রতিটি বাড়ি এবং ব্যক্তিকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সকলের জন্য বাসস্থান, ঘরে ঘরে জল, সকলের জন্য বিদ্যুৎ, সকলের জন্য গ্যাস, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সকলের সর্বাত্মক ও সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে সরকার কাজ করে চলেছে। এর মধ্যে সমস্ত স্তরের মানুষ রয়েছেন। তিনি বলেন, “২০৪৭ সালের মধ্যে ‘বিকশিত ভারত’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে চলেছি। সেই লক্ষ্য অর্জনে মানুষের সক্ষমতা এবং তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রয়োজন রয়েছে।”
বিপুল করতালির মধ্যে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেন, গত ১০ বছরে ভারতের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন ভারতবাসী। তিনি বলেন, “কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্পোদ্যোগের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে। অর্থনীতি এখন এক নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। সর্বস্তরে উন্নয়নের সুফল দেখা যাচ্ছে। দেশে এক নতুন লক্ষ্য ও আশার সঞ্চার হয়েছে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবকা সাথ’ মন্ত্রকে সামনে রেখে গত ১০ বছরে ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে তুলে আনা হয়েছে। সরকারের প্রয়াস মানুষের মনে এক নতুন শক্তির সঞ্চার করেছে। তিনি জানান, ‘প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনা’য় ৪৩ কোটি প্রাপককে ২২.৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘মুদ্রা যোজনা’য় ঋণ দেওয়া হয়েছে ৩০ কোটি মহিলা শিল্পোদ্যোগীকে।
শ্রীমতী সীতারমন বলেন, ভারতের অগ্রগতির চালিকাশক্তি হিসেবে পূর্বাঞ্চল এবং সেখানকার মানুষের উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (গ্রামীণ) ৩ কোটি বাড়ি তৈরির লক্ষ্যমাত্রা প্রায় পূরণ হওয়ার পথে। আগামী পাঁচ বছরে আরও ২ কোটির বেশি বাড়ি তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হবে। একইভাবে, ১ কোটি বাড়ির ছাদে সৌরবিদ্যুৎ বসানোর কথাও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী কিষাণ সম্পদ যোজনায় ৩৮ লক্ষ কৃষক উপকৃত এবং ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান শ্রীমতী সীতারমন। তিনি বলেন, প্রযুক্তিতে দক্ষ আমাদের তরুণদের কাছে এটি হল সোনালী যুগ। তাঁদের ৫০ বছরের জন্য সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে ১ লক্ষ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের কথা ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী।
বিদ্যুৎ, খনিজ পদার্থ এবং সিমেন্টের ক্ষেত্রে রেলের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক করিডর গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেন তিনি। সেইসঙ্গে, বন্দর যোগাযোগ করিডরের কথাও জানান কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। মানুষ যাতে নিরাপদে ও স্বচ্ছন্দে রেল সফর করতে পারেন, সেজন্য ৪০ হাজার সাধারণ বগিকে বন্দে ভারত-এর উপযোগী করে তোলার কথা ঘোষণা করেন তিনি।
অসামরিক বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে বিমানবন্দরের সংখ্যা দ্বিগুণ হওয়ার কথা জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন ৫১৭টি নতুন রুটে ১.৩ কোটি যাত্রী যাতায়াত করছেন। যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে ১ হাজারের বেশি নতুন বিমান তৈরির বরাতের কথাও জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরির কথাও জানান শ্রীমতী নির্মলা সীতারমন। সেইসঙ্গে, ৭৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের প্রসঙ্গও টেনে আনেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা, নতুন অঙ্গীকার নিয়ে দেশের উন্নয়নে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, দেশের সামনে এখন প্রচুর সম্ভাবনা ও সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।”
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, “এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের সঠিক নীতি, সদিচ্ছা এবং সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য। জুলাই-এ পূর্ণাঙ্গ বাজেটে আমরা ‘বিকশিত ভারত’-এর বিস্তারিত রোডম্যাপ তুলে ধরব।”
সংক্ষিপ্ত বাজেট – দ্বিতীয় পর্ব
অন্তর্বর্তী বাজেটে কর কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন ঘটানো হয়নি। আমদানি শুল্ক সহ প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ কর-এর হারও একই রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে, স্টার্ট-আপ এবং লগ্নিতে কর-এর ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
মানুষের জীবনযাপন সহজ করা এবং সহজে ব্যবসার পথ সুগম করতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন শ্রীমতী নির্মলা সীতারমন। এই লক্ষ্যে করদাতাদের উন্নত পরিষেবা প্রদানের কথাও ঘোষণা করেন তিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করদাতাদের সঙ্গে কর সংক্রান্ত বিবাদের নিষ্পত্তিতে অন্তর্বর্তী বাজেটে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। এর ফলে, প্রায় ১ কোটি করদাতা উপকৃত হবেন বলে জানিয়েছেন শ্রীমতী সীতারমন।
প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহ বেড়ে তিনগুণ
করদাতাদের প্রশংসা করে শ্রীমতী সীতারমন বলেন, গত ১০ বছরে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ তিনগুণের বেশি বেড়েছে এবং আয়কর রিটার্ন পেশ করা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২.৪ গুণ। তিনি জানান, নতুন কর ব্যবস্থায় বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কোনো কর দিতে হয় না। দেশীয় সংস্থাগুলির জন্য কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করার কথা উল্লেখ করেন শ্রীমতী সীতারমন। তিনি বলেন, গত ৫ বছর ধরে সরকার করদাতাদের উন্নত পরিষেবার ওপর বিশেষ নজর দিয়েছে। ২০২৩-১৪ সালে যেখানে রিটার্ন যাচাইয়ের জন্য ৯৩ দিন সময় লাগত, সেখানে তা এখন ১০ দিনে নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
জিএসটি আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করে শ্রীমতী নির্মলা সীতারমন জানান, জিএসটি বাণিজ্য ও শিল্প মহলকে ভারমুক্ত করেছে। ৯৪ শতাংশ শিল্পপতি জিএসটি-র ইতিবাচক সুফলের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, চলতি বছরে মাসিক গড় জিএসটি সংগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে ১.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এসজিএসটি-র মাধ্যমে রাজ্যগুলিও উপকৃত হচ্ছে। জিএসটি-র ফলে পণ্য পরিবহণের খরচ এবং কর-এর পরিমাণও অনেক কমে আসায় উপভোক্তারা বেশি উপকৃত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বলেন, ধাপে ধাপে দেশের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে এবং সরকার সাফল্যের সঙ্গে ‘দেশ সর্বাগ্রে’ নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে, যেখানে ‘২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের কী অবস্থা ছিল এবং এখন দেশ কী অবস্থায় রয়েছে’, তা তুলে ধরা হবে।